বর্তমানে সারাদেশে করোনা সংক্রমণ আবারও উর্ধ্বমুখী হলেও গোপালগঞ্জে এখনো পর্যন্ত করোনা পরীক্ষা শুরু হয়নি, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বড় ঝুঁকি তৈরি করছে। দেশের অন্যান্য জেলার মতো গোপালগঞ্জেও জ্বর, সর্দি-কাশি ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে উপসর্গযুক্ত রোগীদের ভিড় বাড়লেও এখনো পর্যন্ত কোনো স্থানে করোনা সনাক্তকরণের জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
পরীক্ষার কীট ও জনবলের সংকট: দায়বদ্ধতার প্রশ্ন
গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ এবং ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল সহ বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতালগুলোতে করোনা পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর (RT-PCR) সুবিধা থাকলেও, তা চালু করা সম্ভব হয়নি একাধিক সমস্যার কারণে। প্রথমত, করোনা পরীক্ষার কীট এখনো এসে পৌঁছায়নি। দ্বিতীয়ত, পূর্বে যে প্রতিষ্ঠানের সাথে আরটি-পিসিআর পরিচালনার জন্য চুক্তি ছিল, তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন আর জনবল নেই।
ফলে, বহুদিন যাবৎ আরটি-পিসিআর ল্যাব বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। এটি শুধু অপ্রস্তুত অবস্থা নয়, বরং একটি জেলাজুড়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যর্থতার স্পষ্ট উদাহরণ।
সচেতনতার অভাবে উদ্বেগ বাড়ছে তৃণমূল পর্যায়েঃ
গোপালগঞ্জ জেলার বাজার, হাট এবং হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জনগণের মধ্যে করোনা নিয়ে এখনও যথেষ্ট সচেতনতা তৈরি হয়নি। অনেকে মাস্ক পরিধান না করেই হাসপাতালে যাতায়াত করছেন, যা সংক্রমণের সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যদিও হাতে গোনা কয়েকজন মাস্ক ব্যবহার করছেন, তারা বলছেন— “করোনা ফিরে আসছে তা অনেকেই জানে না।”
এমতাবস্থায়, গ্রাম পর্যায় থেকে শুরু করে শহর পর্যন্ত সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে লোকজন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে শুরু করে। অন্যথায় পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে।

উপসর্গযুক্ত রোগীর চাপ বাড়ছে প্রতিদিনইঃ
বর্তমান মৌসুমে বৃষ্টি, গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। প্রতিদিনই জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে উপসর্গযুক্ত শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। কিন্তু করোনার পরীক্ষা না হওয়ায়, এসব রোগীর প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে একদিকে যেমন সঠিক চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে রোগ বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ছে।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতিক্রিয়া: আশার আলো ও বাস্তবতাঃ
গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজের পরিচালক ডাঃ প্রেমানন্দ মন্ডল, ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ জীবিতেষ বিশ্বাস এবং সিভিল সার্জন ডাঃ আবু সাইদ মোঃ ফারুক—তিনজনই একমত যে খুব শিগগির করোনা পরীক্ষার কীট আসবে এবং পরীক্ষা শুরু হবে।
সিভিল সার্জনের দাবি, ইতোমধ্যে জেলার প্রতিটি হাসপাতালে করোনা উপসর্গযুক্ত রোগীদের আলাদা রাখার জন্য বিশেষ শয্যার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— কীট না থাকলে সেই শয্যা কতটা কার্যকর হবে?
আরও দেরি হলে বড় ধরনের সংক্রমণ আশঙ্কাঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে, গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে খুব দ্রুত করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তে পারে। কারণ, পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে সংক্রমণের হারের প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব নয়। একইসাথে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অজান্তেই অন্যদের সংক্রমিত করতে পারেন।
গোপালগঞ্জে যদি এখনই পরীক্ষা শুরু করা না হয় এবং যথাযথ সচেতনতা না বাড়ানো হয়, তাহলে একটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্য সংকটের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
করোনা পরীক্ষার প্রস্তুতি ও সুপারিশঃ
আমরা মনে করি, গোপালগঞ্জে করোনা পরীক্ষার জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করা উচিত:
- অবিলম্বে করোনা পরীক্ষার কীট সরবরাহ নিশ্চিত করা
- আরটি-পিসিআর রুম সচল করার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ
- হাসপাতালে আগত সকল রোগীর মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা
- সচেতনতা বৃদ্ধিতে স্থানীয় পর্যায়ে প্রচার অভিযান চালানো
- উপসর্গযুক্ত রোগীদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড চালু করা ও নিয়মিত মনিটরিং করা
তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবিঃ
গোপালগঞ্জের জনগণের মধ্যে সঠিক তথ্য এবং স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় ভূমিকা রাখা জরুরি। একমাত্র জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ সম্ভব। পাশাপাশি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।
উপসংহার: সময় এখনই পদক্ষেপ নেওয়ারঃ
গোপালগঞ্জের করোনা পরিস্থিতি এখনো সংকটময় রূপ নেয়নি, তবে সতর্কতা অবলম্বন না করলে পরিস্থিতি খুব দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই এখনই প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি, পরীক্ষার কীট সরবরাহ এবং আরটি-পিসিআর চালুর মতো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এ বিষয়ে দ্রুততার সাথে কাজ করলে করোনা সংক্রমণের বিস্তার রোধ করা সম্ভব। জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ এবং প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগই পারে গোপালগঞ্জকে নিরাপদ রাখতে।