দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলবাসীর আরেকটি স্বপ্নপূরণ হলো। স্বপ্নের ‘পদ্মা সেতু’র পর এবার গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার কালনা পয়েন্টে ‘মধুমতি সেতু’র দ্বার উন্মোচন হরো। এটি দেশের প্রথম ছয় লেনের ধুনকার্তির সৌন্দর্যবর্ধক সেতু।
মধুমতি সেতু চালু হওয়ায় শুধু জাতীয় ক্ষেত্রেই নয়, এটি ব্যবসা-বানিজ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। ভারতের কোলকাতা, আসামসহ দেশের মধ্যে স্থলবন্দর, বিশেষ করে সাতক্ষীরার ভোমরা,
যশোরের বেনাপোল ও নোয়াপাড়া নদীবন্দরের মধ্যে যোগাযোগের মাইলফলক সৃস্টি হলো। আজ সোমবার দুপুর ১২টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি এই সেতুর শুভ উদ্বোধন করেন। এরপর সেতুটিতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানাগেছে, সেতুর পূর্বপাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার শংকরপাশা এবং পশ্চিমপাড়ে নড়াইল লোহাগড়া অংশ। মাঝে প্রবাহিত মধুমতি নদী। এই নদীর ওপরই নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ছয় লেনের কালনা সেতু।এলাকাবাসী এটাকে এতোদিন কালনা সেতু হিসাবে চিনলেও পরে প্রধানমন্ত্রী সেতুটির নাম পরিবর্তন করে মধুমতি সেতু নামকরণ করেন।
সড়ক বিভাগের কথাঃ
সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, “কালনায় দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু। নেলসন লোস আর্চ টাইপের (ধনুকের মতো বাঁকা) সেতু এটি। এটি কেন্দ্রীয় স্প্যান।
১৫০ মিটারের স্টিলের তৈরী স্প্যানটি ভিয়েতনাম থেকে তৈরী করা আনা হয়েছে। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার ও প্রস্থ্ ২৭ দশমিক ১০ মিটার। ৬লেনের সেতুর ৪ টিতে দ্রুতগতির এবং দুইটিতে ধীর গতির যানবাহন চলাচল করবে।
সেতুর দুই পাশে ৪ দশমিক ২৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক । এর মধ্যে ৮টি আন্ডারপাস ও ১৪টি কালভার্ট রয়েছে। তৈরী করা হয়েছে ৮লেন বিশিষ্ট টোল প্লাজা। ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৭০ দশমিক ২ শূন্য ৮ একর। ফলে সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাড়িয়েছে ৯৫৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
তিনি আরো বলেন,এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এই মধুমতি সেতু। সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সিলেটের তামাবিল হয়ে ঢাকা, ভাঙ্গা, নড়াইল, যশোর, বেনাপোল, কলকাতা পর্যন্ত সরাসরি এই সেতু ভূমিকা রাখবে। এতোদিন কালনা পয়েন্টে মধুমতি নদী এই যোগাযোগটাকে বিছিন্ন করে রেখেছিল। সেতু নির্মাণের ফলে সেই বিছিন্নতা আর রইল না।”
সেতু কর্র্তৃপক্ষ সূত্রে জানাগেছে, ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর এ সেতুর নির্মাণ কাজের শুভ উদ্বোধন করেন।
কালনাঘাট থেকে ঢাকার দুরত্ব মাত্র ১০৮ কিলোমিটার। ফলে ঢাকার সঙ্গে নড়াইল, বেনাপোল, যশোর, খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা,মেহেরপুর, কুষ্টিয়াসহ আশেপাশ জেলার সড়ক যোগাযোগ ৮৬ কিলোমিটার কমে যাবে।
প্রশস্ত সড়ক দাবী
তবে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরণের সড়ক নির্মিত হয়নি। ফলে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’র সুফল পাচ্ছে না দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বড় একটি অংশ। তাই এই অংশে চার লেন সড়ক নির্মাণের দাবী এলাকাবাসীর।
ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে দুই লেন সড়ক চালু আছে। এই অংশে ‘এক্সপ্রেস ওয়ে’ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি প্রকল্পাধীন বলে জানিয়েছেন কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আশরাফুজ্জামান। তিনি বলেন, কালনা সেতু চালু হলে যানবাহনের চাপ বেড়ে যাবে।
তাই আপাতত যশোরের মনিহার সিনেমা হল চত্বর থেকে নড়াইলের কালনাঘাট পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার সড়ক প্রশস্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি ১৮ফুট প্রশস্ত থাকলেও তা বাড়িয়ে ২৪ ফুট করা হবে।
দরপত্রের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দরপত্র অনুমোদন হলে দুই সপ্তাহের মধ্যে ওয়ার্ক অর্ডার দেয়া হবে। নড়াইল অংশে প্রায় ৪৭ কোটি এবং যশোর অংশে ৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক প্রশস্তকরণ করা হবে। এ লক্ষ্যে সড়কের দুই পাশে গাছকাটার কাজ শুরু হয়েছে।

ঘাটে বিড়ম্বনাঃ
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কালনা সেতু নির্মিত হয়েছে। কালনা সেতু চালু না হওয়ায় কলকাতা-ঢাকা ভ্রমণকারী-সহ নড়াইল, যশোর,
বেনাপোল, নোয়াপাড়া শিল্পনগর, সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর-সহ আশেপাশের কয়েকটি জেলার লোকজন পদ্মা সেতুর সরাসরি সুফল পাচ্ছিলেন না। কারণ, কালনাঘাটে এসে ফেরি পারাপারের বিড়ম্বনায় পড়তে হতো সব ধরনের যানবাহনকে। ফেরি পার এড়াতে বহু বাস ও অন্যান্য যানবাহন ফরিদপুর, মাগুরা এবং গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা ঘুরে কলকাতায় যেতো।

কলকাতা দূরত্ব কমবেঃ
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর এবার চালু হলো কালনায় মধুমতি সেতু। কলকাতা ও ঢাকাকে আরও কাছে নিয়ে আসবে ফরিদপুর ও নড়াইল জেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতী নদীর ওপর নির্মিত এই মধূমতি সেতু। সেতু চালু হওয়ায় ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব প্রায় ২০০ কিলোমিটর কমে আসবে। শুধু যাত্রী নয়, পরিবহণ খরচেও বিপুল সাশ্রয় হবে। সময়ও কম কম লাগবে।
টোল হারঃ
কালনায় মধুমতি নদীর উপর নির্মিত মধুমতি সেতুর টোল হার নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাই দেশের প্রথম ৬ লেনের সেতু। টোল প্লাজায় যানজট এড়াতে ৮ লেনের টোল কাউন্টার নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মধুমতি সেতুর টোল হার হলো, কন্টেইনার ও ভারী ট্রাক ৫৬৫ টাকা,
বড় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ৪৫০ টাকা, মাঝারী ট্রাক ২২৫, ছোট ট্রাক ১৭০ টাকা, কৃষি কাজে ব্যবহৃত পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর ১৩৫ টাকা, বড় বাসের ক্ষেত্রে ২০৫ টাকা, মিনিবাস বা কোস্টার ১১৫ টাকা,
মাইক্রোবাস, পিকাপ, কনভারশনকৃত জিপ ও রে-কার ৯০ টাকা, প্রাইভেটকার ৫৫ টাকা, অটোটেম্পু, সিএনজি অটোরিকশা, অটোভ্যান ও ব্যাটারিচালিত ৩ চাকার যান ২৫ টাকা, মোটরসাইকেল ১০ টাকা এবং রিকশা, ভ্যান ও বাইসাইকেল ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রতিশ্রুতিঃ
নড়াইলসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে ২০০৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নড়াইলের সুলতান মঞ্চে নির্বাচনী জনসভা করেন। সেই জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মধুমতি নদীর কালনা পয়েন্টে সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
এরপর ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘কালনা সেতু’ নামে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সেতুটি নির্মাণের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়িত হলো।
উচ্ছাসঃ
চরকালনা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ ইব্রাহীম শেখের ছেলে ও কাঁচামাল ব্যবসায়ী মোঃ জামাল হোসেন (৪২) বলেন, কালনা সেতু আমাদের প্রাণের দাবী ছিলো। দেরীতে হলেও সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আজ সেটি উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী।
সেতুটি চালু হওয়ায় আমাদের এলাকা এবং নড়াইল জেলাসহ পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার উতপাদিত কৃষিপন্য সহজে দেশব্যপি পাঠানো সম্ভব হবে। কৃষক ন্যায্যমূল্য পাবেন। ঢাকার মানুষ মধুমতি ব্রিজ পার হয়ে অনাসায়ে বেনাপোল বর্ডার হয়ে ভারত যেতে পারবেন। যাতায়াতের জন্য একটা নতুন দিগন্ত সৃস্টি হবে।
১৪৪নং চরজঙ্গল মুকুন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, মধুমতি নদীর কালনায় খেয়া ও ফেরী পারাপার হয়েছি। এতে আমাদের ভোগান্তী হতো। টাকা পয়সাও বেশী খরচ হতো। ব্রীজ চালু হওয়ায় আমাদের আর ভোগান্তী থাকবেনা। সহজে যাতায়াত করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে সুবিধা হবে।
লোহাগড়া গ্রামের হাবিবুর রহমান, হাবিল মোল্লা, আহম্মদ আলী শেখ, নাসির উদ্দিন, শংকরপাশা গ্রামের জিকরুল শেখ, নারগিস সুলতানা , কমলেস বিশ্বাস সহ কথা হয় অনেকের সঙ্গে। তারা বলেন, কালনা সেতু হয়ে যশোর,
বেনাপোল, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলায় যেতে পারবো। এখন আর খেয়া বা ফেরীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। যখন ইচ্ছা তখন যাতায়াত করতে পারবো। প্রধানমন্ত্রী কথা দিয়েছিলেন, তিনি কথা রেখেছেন। এই জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
গোপালগঞ্জ অংশের আলাদা অনুষ্ঠান

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে যুক্ত ছিলো গোপালগঞ্জ প্রান্ত। অনুষ্ঠানে সংরক্ষিত ২৫ আসনের সংসদ সদস্য নার্গিস রহমান, জেলা প্রশাসক শাহিদা সুলতানা, পুলিশ সুপার আয়েশা সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জ সড়ক জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. সুরুজ মিয়া, সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তাপসী দাশ,
ক্রস বর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমগ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (বাংলাদেশ) এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি চৌধুরী এমদাদুল হক, সাধারন সম্পাদক মাহাবুব আলী খান,
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল বশার খায়ের, কাশিয়ানী উপজেলা চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর, টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র শেখ তোজাম্মেল হক টুটুলসহ ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, প্রশাসনের উর্দ্ধধন কর্মকর্তাবৃন্দ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীগণ উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে, মধুমতি সেতু উদ্বোধনের আনন্দ জনগনের সাথে ভাগাভাগি করতে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান মধুমতি সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া গোল চত্বরে স্থানীয় নেতা-কর্মিদের নিয়ে সমাবেশ করেছেন।
সমাবেশে কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোক্তার হোসেন, সাধারন সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, মুকসুদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রবিউল আলম শিকদার, সাধারন সম্পাদক সাইদুর ইসলাম টুটুল প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।